সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৮ অপরাহ্ন
শায়লা শারমিন, ময়মনসিংহ থেকে ফিরেঃ ময়মনসিংহ শহরের পুরোহিতপাড়ায় বর্তমানে প্রতি কাঠা জমির দাম ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। তা-ও সব সময় গ্রাহক পাওয়া যায় না। কিন্তু শহরের অন্যান্য স্থানে প্রতি কাঠা জমির দাম কম-বেশি ৪০ লাখ টাকা। নগরীর স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। পুরোহিতপাড়ার সঙ্গে শহরের অন্যান্য এলাকার জমির দামের বড় ব্যবধানের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, পুরোহিতপাড়া, কেওয়াটখালী ও কৃষ্টপুর মাদকের আখড়া বলে পরিচিত। ফলে সেখানে জমি কেনা বা বসবাসে মানুষের আগ্রহ কম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও শহরবাসীর সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, পুরোহিতপাড়ার মতো কৃষ্টপুর, কেওয়াটখালী ও পুরোহিতপাড়া মাদকের আখড়া। এ তিনটি স্থান থেকে শহরে ভয়ংকরভাবে মাদক ছড়াচ্ছে। বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও লাগছে মাদকের সর্বনাশা ছোবল। ২০২২ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীপ মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, ময়মনসিংহ মহানগীতে মাদকাসক্ত ছিলেন প্রায় ছয় হাজার মানুষ। গত দুই বছরে মাদকসেবীর সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, ময়মনসিংহে পুলিশ ও অধিদপ্তরের অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়েন না।
ধরা পড়ে মাদকসেবী কিংবা বহনকারীরা। গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে অধিদপ্তর শহর এবং বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় ২০ হাজার কেজি গাঁজার পাশাপাশি ইয়াবা বড়ি, হেরোইনসহ অন্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশিদুল ইসলাম বলেন, ময়মনসিংহে যে হারে মাদকের ব্যবহার বাড়ছে, তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, যা উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য উদ্ধারে অভিযানও চালানো হচ্ছে। মাদকসেবী ও নিরাময় কেন্দ্র: দীপের জরিপ অনুযায়ী, শহরের প্রায় সাড়ে চার হাজার মাদকাসক্ত ব্যক্তির মধ্যে যুবক বয়সী প্রায় আড়াই হাজার।
কিশোর প্রায় এক হাজার ২০০। বাকিরা অন্যান্য বয়সের। জানা গেছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় শহরে ১৮টি নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও এর একটিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদনপ্রাপ্ত নয়। গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে এসব কেন্দ্রে প্রায় ২০০ মাদকসেবী চিকিৎসাধীন ছিল। কিছু নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মাদক বেচাকেনার অভিযোগও রয়েছে। কয়েকটি নিরাময় কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নেওয়া, হেরোইন ও ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বেশি। ফেনসিডিল, গাঁজা, পেস্টিংয়ে (একধরনের রাসায়নিক, যা পলিথিনের থলেতে ভরে শ্বাস নেওয়া হয়) আসক্ত ব্যক্তিরাও আছে। অনেকে একাধিক রকম মাদক নেয়। দীপ মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আরিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি মাদকসেবী ছিলাম। ওই পথ থেকে ফিরে এসে নিরাময় কেন্দ্র দিয়েছি।’
নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মাদক বেচাকেনার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। কারণ, এ ধরনের ঘটনা হলে মাদকসেবীরা বাইরে বলে দিত।’ মাদকের আখড়া: সরেজমিনে ঘুরে, পুলিশ ও নিরাময় কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরোহিতপাড়া, কিষ্টপুর ও কেওয়াটখালী মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত। এসব জায়গা থেকেই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং শহরের অন্যত্র মাদক ছড়ায়। শহরের সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত আলালের বাড়ি পুরোহিতপাড়ায়। মাদক বেচার জন্য তাঁর বেতনভোগী কর্মীও আছেন। কৃষ্টপুরে তিনজন এবং কেওয়াটখালীতে একজন মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলাল সম্প্রতি পুরোহিতপাড়ায় চারতলা বাড়িসহ জমি কিনেছেন। পুরোহিতপাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, আলালের বাসায় পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার যাতায়াত আছে। ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাউন উদ্দিন বলেন, গত ১৫ দিনে মাদকসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ২৩ টি মামলা হয়েছে। পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে না—এ অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখন মাদক বেচাকেনায় মুঠোফোন ব্যবহূত হয়। ব্যবসায়ীরা বাহকের মাধ্যমে নির্দেশিত স্থানে মাদক পাঠান। ফলে ধরা পড়ে বহনকারীরাই।